শেয়ারবাজার লুটের মাস্টারমাইন্ড: চৌধুরী নাফিজ সরাফত - পর্ব ৪

শেয়ারবাজার লুটের মাস্টারমাইন্ড: চৌধুরী নাফিজ সরাফত - পর্ব ৪

পুজিবাজারের এক কলংকিত নাম চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। এমন কোন অপকর্ম নেই যা সে গত আওয়ামী সরকারের আমলে করেনি। নাফিজ সরাফত চেয়েছেন কিন্তু হয়নি, পুঁজিবাজারে এমন ঘটনা নেই বলে জানান বাজারসংশ্লিষ্টরা। তার মালিকানাধীন ১০টি ফান্ডের সর্বোচ্চ মেয়াদ ১০ বছর ছিল। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও এগুলোর অবসায়ন হয়নি, নাফিজ সরাফতের তদবিরে বরং আরও ১০ বছর বেড়েছে। তখন বিএসইসির চেয়ারম্যান ছিলেন এম খায়রুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘তহবিলগুলোর মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব শুরুতেই আমি নাকচ করে দিয়েছিলাম। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তখন চিঠি দিয়ে বললেন, এটা দেওয়া যায়। তখন দিতে হয়েছিল।’ মূলত এসব মিউচুয়াল ফান্ডকে ব্যক্তিস্বার্থে অর্থ উপার্জনের কাজে লাগিয়েছেন চৌধুরী নাফিজ সরাফত।
নাফিজ সরাফতের সঙ্গে সালমান এফ রহমান, নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ ব্যাংক ও আর্থিক খাতের প্রভাবশালীদের সুসম্পর্ক ছিল। নজরুল ইসলাম মজুমদারকে নিজের গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন নাফিজ সরাফত। জনশ্রুতি রয়েছে, সালমান এফ রহমান যখন তাঁর বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারদর বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন জনকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করছিলেন, তখন তাতে সাড়া দিয়ে নাফিজও তাঁর ফান্ডের অর্থ কোম্পানিটির শেয়ারে বিনিয়োগ করেছেন। যদিও পরবর্তী সময়ে সালমান এফ রহমানকে না জানিয়ে বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ায় বাজারে কোম্পানিটির শেয়ারদর পড়ে যায়। এতে নাফিজ সরাফতের ওপর ক্ষুব্ধ হন সালমান এফ রহমান। সালমান এফ রহমানের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে নাফিজ সরাফত সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। তৎকালীন অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদারের সঙ্গেও তাঁর সখ্য ছিল। আ হ ম মুস্তফা কামালকে কাজে লাগিয়ে বেস্ট হোল্ডিংসের আইপিও ডিরেক্ট লিস্টিংয়ের অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার সুপারিশ আদায় করেছিলেন নাফিজ সরাফত। যদিও শেষ পর্যন্ত এটি সফল হয়নি। এর কয়েক বছর পর বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত বেস্ট হোল্ডিংসকে তালিকাভুক্ত করাতে সক্ষম হন তিনি। বেস্ট হোল্ডিংসের প্লেসমেন্ট শেয়ার সাবেক আইজিপি বেনজীরের দুই মেয়ের নামে বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন নাফিজ সরাফত। মূলত প্লেসমেন্ট শেয়ার বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের উপহার দেওয়ার মাধ্যমে নাফিজ তাঁর প্রভাব বজায় রাখতেন। এ প্রভাব কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সুবিধাও আদায় করে নিয়েছেন তিনি। এ কারণে সরকারের কোনো দপ্তরে নাফিজের কোনো কাজ আটকে থাকত না। ফলে অনেকেই তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে নিজেদের স্বার্থ আদায় করেছেন। এ ক্ষেত্রে লবিংয়ের জন্য নাফিজ সরাফত তাঁদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি বেস্ট হোল্ডিংসের বন্ডে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য চৌধুরী নাফিজ সরাফত চাপ দিয়েছিলেন বলে সমাজমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেডের (বিআইএফএফএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরমানুল ইসলাম। সে সময় তৎকালীন অর্থ সচিব আবদুর রউফ চৌধুরীর অফিসকক্ষে সালমান এফ রহমান ও চৌধুরী নাফিজ সরাফত উপস্থিত ছিলেন বলে তিনি জানিয়েছেন। অবশ্য এ সাক্ষাতের কিছুদিন পরই ফরমানুল ইসলামকে প্রতিষ্ঠানটি থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।
নাফিজ সরাফত সব সময় বড় প্রকল্প লক্ষ করেই তাঁর পরিকল্পনা সাজাতেন। কিন্তু কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের মতো ছোট কোম্পানির আইপিও অনুমোদন করিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর লবিং করার বিষয়টি অনেককেই অবাক করে দেয়। মূলত কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের প্লেসমেন্ট শেয়ার অনেক প্রভাবশালীকে দিয়েছিলেন নাফিজ সরাফত। এ কারণে কোম্পানিটিকে যে কোনোভাবেই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির জন্য তিনি উঠেপড়ে লেগেছিলেন। অবশ্য কপারটেকের আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়মের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিষয়টি আটকে যায়। নিরীক্ষকের বিষয়ে তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি)। এর ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষক আহমেদ অ্যান্ড আখতারকে নিষিদ্ধ করে আইসিএবি। সে সময় কপারটেক ইস্যুতে এফআরসিতে লবিংয়ের জন্য গিয়েছিলেন নাফিজ সরাফত। নাফিজ ডিএসইর প্রয়াত এক সভাপতিকে দিয়ে শেষ পর্যন্ত কপারটেককে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে আইনি ছাড়ের জন্য স্টক এক্সচেঞ্জটির পক্ষ থেকে বিএসইসির কাছে চিঠি পাঠাতে সক্ষম হন। এরই ধারাবাহিকতায় আইনি ছাড় দেয় বিএসইসি এবং শেষ পর্যন্ত কপারটেক তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটির আইপিও প্রক্রিয়ায় ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন এমটিবি ক্যাপিটালের প্রধান নির্বাহী খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ। তাঁকে পরবর্তী সময়ে ডিএসইর প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিআরও) হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে সহায়তা করেন নাফিজ সরাফত।
নাফিজ সরাফত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশ কিছু কোম্পানির নিয়ন্ত্রণও নিয়েছিলেন। এর মধ্যে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস, ন্যাশনাল টি কোম্পানি অন্যতম। তিনি ইউনিক হোটেলের উদ্যোক্তা নূর আলীর প্রতিষ্ঠানের মনোনীত পরিচালক হিসেবে কোম্পানিটির পর্ষদে পরিচালক হয়ে আসেন। পাশাপাশি ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ারের মালিকানায়ও যুক্ত হন নাফিজ সরাফত। মূলত তাঁর মালিকানাধীন স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্স লিমিটেডের মাধ্যমে তিনি ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেন। ৫৮৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল বিনিয়োগ ইউনিক গ্রুপের হলেও বিভিন্ন ধরনের দরকষাকষি ও অনুমোদন পাইয়ে দেওয়ার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন নাফিজ সরাফত। ফলে কম বিনিয়োগ করেও তিনি এ প্রকল্প থেকে আকর্ষণীয় মুনাফা করতে সক্ষম হন। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে এসএফএলের ৩৮ দশমিক ৭৬, ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসের ৩৭ দশমিক ২৪ এবং কাতারভিত্তিক নেব্রাস পাওয়ারের ২৪ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। নেব্রাস পাওয়ারের কাছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ২৪ শতাংশ শেয়ার ২ কোটি ৪০ লাখ ডলারে বিক্রি করা হয়। এ ক্ষেত্রে ৫১ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছে নাফিজের প্রতিষ্ঠান এসএফএল আর ৪৯ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছে ইউনিক হোটেল। এ শেয়ার বিক্রি করে নাফিজের প্রতিষ্ঠান শতকোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ন্যাশনাল টি কোম্পানির পর্ষদে ফাইনেক্স সফটওয়্যার লিমিটেডের মনোনীত পরিচালক হিসেবে চৌধুরী নাফিজ সরাফত জায়গা করে নেন। কোম্পানিটি নতুন শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ২৭৯ কোটি টাকার মূলধন বৃদ্ধির জন্য বিএসইসির কাছ থেকে অনুমোদন পায়।
স্টক এক্সচেঞ্জের বিরূপ মন্তব্য সত্ত্বেও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেনের সময় অনেক আইপিও অনুমোদন করা হয়েছে। তবে কপারটেক ইস্যুতে সমালোচনা শুরু হলে কমিশন স্টক এক্সচেঞ্জের মতামত ছাড়া আইপিও অনুমোদন না করার নীতি গ্রহণ করে। মূলত এ ক্ষেত্রে কৌশলে কপারটেকের আইপিও অনুমোদনের দায় ডিএসইর ওপর চাপানোর কৌশল নেওয়া হয়। যদিও আইপিও বাতিলের আইনি ক্ষমতা কমিশনের ছিল। তা ছাড়া তার বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও খায়রুল হোসেন কোনো ধরনের তদন্ত বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এমনকি একবার স্ট্রেটেজিক লিমিটেড এর কার্যক্রম পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে সেটি আর বাস্তবায়ন হয়নি। ডিরেক্ট লিস্টিংয়ের জন্য অনুমোদন না দিয়ে বেস্ট হোল্ডিংসকে আইপিওতে আনতে নাফিজ সরাফতের প্রচেষ্টা রুখে দিয়েছিল শিবলী কমিশন। যদিও এ কমিশনই পরবর্তী সময়ে কোম্পানিটি তালিকাভুক্তির অনুমোদন দিয়েছে। তা ছাড়া শিবলী কমিশনের সময় নাফিজের বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। নাফিজ সরাফতের বিরুদ্ধে স্ট্রেটেজিক এসেট ম্যানেজমেন্টের ফান্ডগুলোর অপব্যবহারের মাধ্যমে অর্থ কামানোর অভিযোগ রয়েছে। সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে তার প্রশ্নবিদ্ধ বিনিয়োগের বিষয়টিতে নাফিজ সম্পৃক্ত ছিলেন। রিজেন্ট স্পিনিং মিলের প্রাতিষ্ঠানিক বন্ড ও পদ্মা ব্যাংকের মতো বিতর্কিত বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও নাফিজের দায় রয়েছে বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে মিউচুয়াল ফান্ড রুলস ভঙ্গ করে নিজের ব্যবস্থাপনায় থাকা মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে পুজিবাজারের ব্লক মার্কেটে বড় ধরনের লেনদেন জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। নাফিজ সরাফত বিভন্নভাবে প্রভাব খাটিয়ে পুজিবাজারের সর্বনাশ করেছেন। সাধারণ ও ছোট বিনিয়োগকারীদের ধ্বংস করে লুটে নিয়েছেন হাজার কোটি টাকা।